লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ একজন প্রাক্তন বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা যিনি নারায়ণগঞ্জ সাত হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন । তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন -১১ এর কমান্ডিং অফিসার।
1. খুনের দোষী সাব্যস্ত হয়েও বহাল তবিয়তে
সাত জন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকার, তাদের দুই চালক এবং তিন সহযোগী, ২ এপ্রিল ২০১৪ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। তিন দিন পরে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে । হত্যাকাণ্ডে জড়িত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের র্যাব নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকার বিনিময়ে নজরুলকে অপহরণ করে হত্যা করেছে র্যাব কর্মীরা । তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেন এবং ২২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড দেন। অন্য নয় আসামীকে ৭ থেকে ১৭ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে ।
2. যেসব অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি।
তারেক সাঈদ ৩ নভেম্বর ২০১৩-তে র্যাব -১১ এর কমান্ডিং অফিসার হন । আরিফ হোসেন ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি র্যাব -১১ এ যোগ দেন । এবং রানা ২ জুলাই ২০১৩-এ র্যাব -১১ এ যোগ দেন। সাঈদ ও র্যাব -১১-এর বিরুদ্ধে কমপক্ষে এক ডজন মামলায় অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ উঠেছে, যার মধ্যে রয়েছে:
শাহাদাত হোসেন জাসু, জাবেদ ও সুমন – ২০১৪ সালের ৩ ও ৫ এপ্রিল র্যাব -১১ নোয়াখালীর উরিরচরে ক্রসফায়ারে শাহাদাত হোসেন জাসু, জাবেদ ও সুমনকে তিন ডাকাতকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে। র্যাব দাবি করেছে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তারা উত্পাদন করতে অক্ষম ছিল।
তাজুল ইসলাম – র্যাব -১১ এর বিরুদ্ধে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-তে হাই-এস মাইক্রোবাসে ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামকে অপহরণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাজুলের লাশ ১৩ দিনের পরে মেঘনা নদীতে পাওয়া গেছে।
সাইফুল ইসলাম হিরু ও কবির পারভেজ – ২৭ শে নভেম্বর ২০১৩, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিএনপি প্রাক্তন সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু এবং বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজ লাকসাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার সময় অপহরণ করেছিলেন। তাদের খুঁজে পাওয়া যায় নি।
হাসান শাওন – কুমিল্লা যুবলীগ নেতা রকিবুল হাসান শাওনকে ২৯ শে মার্চ ২০১৪ এ তার বাসা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং এখনও নিখোঁজ রয়েছে। শাওন একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে; তার মা ১৫ জন র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন।.
ডাঃ ফয়েজ আহমেদ – তারেক সাঈদের নির্দেশে র্যাব -১১ এর বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা ফয়েজ আহমেদকে ২ তলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ করা হয়েছিল।
ইসমাইল হোসেন – র্যাব-১১ এবং তারেক সাঈদ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল থেকে নিখোঁজ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত।
ইকবাল মাহমুদ জুয়েল – তারেক সাঈদের নির্দেশে র্যাব -১১ এর বিরুদ্ধে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিন সাবুর সামনে ইকবাল মাহমুদ জুয়েলকে দুটি গাড়ি জ্বালিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠল।
মোসলেম উদ্দিন – চাটখিল থানা নোয়াখালী যুবলীগ নেতা মোসলেম উদ্দিনকে ৯ ই এপ্রিল ২০১৪ তারিখে র্যাব সদস্যরা তার স্ত্রীর সামনে জনাকীর্ণ বাস থেকে অপহরণ করে এবং নিখোঁজ রয়েছে।
কালাম সিকদার – র্যাব -১১ এর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ত্বকি হত্যা মামলার সাথে কালাম সিকদারকে অপহরণ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল; তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
সরকারের এক প্রভাবশালী নেতার জামাতা হওয়ায় ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ কাউকে পরোয়া করতেন না। তখন নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১ ব্যাটালিয়নের তৎকালীন হেডকোয়ার্টারটি রীতিমতো কসাইখানায় পরিণত হয়।
তাই আলোচিত এ সাত খুন নয়, এর আগেও তারা কমপক্ষে ১১ ব্যক্তিকে প্রথমে গুম, পরে নৃশংসভাবে প্রায় একই কায়দায় খুন করে লাশ গায়েব করে দেয়। এমন লোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে এসেছে খোদ র্যাবের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
তার ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে অন্যতম দুই সহযোগী মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এমএম রানাও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাদের কাছে মানুষ খুন করা ছিল অনেকটা পাখি শিকারের মতো। আজ বুধবার জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
প্রসঙ্গত, র্যাব-১১ এর আওতাধীন এলাকা ছিল নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা। সে কারণে ওই সময় এসব জেলায় গুম-খুনের যেসব ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে র্যাবের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে অনেকে আশংকা করেন।
র্যাবের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তারেক সাঈদের নেতৃত্বে এ ব্যাটালিয়নে কর্মরত র্যাবের বেশিরভাগ কর্মকর্তা অস্ত্র, যানবাহন ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করতেন। ব্যক্তিস্বার্থে তারা অনেক সময় নিরপরাধ লোকজনকেও ধরে আনতেন। তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন ছাড়াও গুম-খুনের মতো পথ বেছে নিতেন। কাউকে দিনের পর দিন ব্যাটলিয়নের গোপন কক্ষে বন্দি রাখা হতো। সাধারণ মানুষের কাছে ওই ব্যাটালিয়ন ছিল একটি টর্চার সেল। অনেক সময় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হতো।
শুধু সরকারবিরোধী লোকজন নয়, তাদের হাত থেকে বাদ যাননি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারাও। মেজর আরিফ ও এমএম রানা যে দুটি ক্রাইম প্রিভেনশন ক্যাম্পের (সিপিসি) অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেখানেও গোপন টর্চার সেল তৈরি করা হয়। র্যাব-১১তে স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী শাহরিয়ারও টাকার লোভে অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুম-খুনে জড়িয়ে পড়েন।
এদিকে সাত খুনের পর অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের বিষয়ে র্যাব সদরদফতর থেকে তাদের বিষয়ে ব্যাপক গোয়েন্দা অনুসন্ধান চালানো হয়। নিজস্ব গোয়েন্দা অনুসন্ধানে (কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স) বেরিয়ে আসে নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও আওতাধীন অন্যান্য জেলার অন্তত ১১ জন গুম-খুনের শিকার হওয়ার তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয় সে সময় যারা নিখোঁজ হয়েছেন এবং আজও সন্ধান মেলেনি তাদের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালালে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ওদিকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করলেও তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। কারণ প্রতিটি মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিল পুলিশ। প্রভাবশালী রাজনীতিকের জামাতা হওয়ার সুবাদে তারেক সাঈদ পুলিশের তদন্তকে প্রভাবিত করেন। ফলে পুলিশ এসব মামলার তদন্তে র্যাবকে অব্যাহতি দিয়ে দায়সারা প্রতিবেদন দেয়। র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদের নেতৃত্বে যেসব ব্যক্তিকে গুম-খুন করা হয় তাদের প্রোফাইল নিচে তুলে ধরা হল।
হাসান শাওন : তারেক সাঈদ র্যাব-১১’র অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত থাকার সময় নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তি একের পর এক নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যে যেমন জামায়াত-বিএনপি রয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ নেতাকর্মীও বাদ যাননি। এর জ্বলন্ত উদাহরণ কুমিল্লার যুবলীগের জনপ্রিয় নেতা রকিবুল হাসান শাওন। ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ তাকে অপহরণ করে র্যাব। শাওন এ সময় তার বাড়িতেই ছিলেন। র্যাবের হাতে অপহরণের আগে তার পরিবারের সদস্যরা এ ধরনের ঘটনার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। কারণ শাওনের বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। ঘটনার পর শাওনের পরিবারের সদস্যরাও অন্য নিখোঁজ পরিবারগুলোর মতো র্যাব ১১’র কার্যালয়ের সামনে দিনভর অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু শাওনের খোঁজ মেলেনি। একপর্যায়ে শাওনের মা আনোয়ারা বেগম আদালতে মামলা করেন। মামলায় সরাসরি ১৫ জন র্যাব সদস্যের নাম উল্লেখ করেন তিনি। মামলাটির তদন্ত শুরু করে কুমিল্লা জেলা ডিবি। কিন্তু রহস্যজনকভাবে মামলায় র্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি মর্মে প্রতিবেদন দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে শাওনের পরিবার। তার মা আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন।
মোসলেম উদ্দিন : ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল নোয়াখালীর চাটখিল থানার যুবলীগ নেতা মোসলেম উদ্দিন নিখোঁজ হন। ঘটনার দিন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসছিলেন। রাত ৩টায় মেঘনা গোমতী ব্রিজের ওপর হঠাৎ যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি করে র্যাব। কয়েকজন র্যাব সদস্য মোসলেম উদ্দিনকে টেনে-হিঁচড়ে বাস থেকে নামিয়ে আনে।এ সময় তার স্ত্রী স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাস থেকে নামানোর পর মোসলেমের চোখ বাঁধা হয়। এরপরের ঘটনা আর কেউ জানে না। মোসলেম আজও ফিরে আসেননি। স্বামীকে ফিরে পেতে তার স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি, মানববন্ধন কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, তার স্বামীকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।
ইসমাইল হোসেন : ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা বালু ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন হঠাৎ করে নিখোঁজ হন। তার পরিবারের সদস্যরা ইসমাইলকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা নিশ্চিত হন ইসমাইলকে র্যাব-১১’র কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ইসমাইলের পরিবারের সদস্যরা র্যাবের কার্যালয়ের সামনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু তাদের এ অসহায় অবস্থা তারেক সাঈদ বা অন্য র্যাব কর্মকর্তাদের মন গলাতে পারেনি।সূত্র জানায়, দীর্ঘ দেন-দরবার করেও ইসমাইলকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় তার পরিবার। একপর্যায়ে তার ছোটভাই আবদুল মান্নান ৬ জনের নাম উল্লেখ করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে র্যাবকে দিয়ে ইসমাইলকে অপহরণ করায় তার প্রতিপক্ষ। এ কাজে সহায়তা করে সাত খুনের মামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেন। নিখোঁজ ইসমাইলের মামলাটি বর্তমানে ডিবি তদন্ত করছে।
সূত্র জানায়, ভারত থেকে ফিরে এলে নূর হোসেনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানায় ইসমাইলের পরিবার। ডিবির তদন্তে বেরিয়ে আসে নূর হোসেনের সহায়তায় তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও এমএম রানা একজোট হয়ে ইসমাইলকে অপহরণ করেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর অভিযোগ দাখিল করে ডিবি। অভিযোগপত্রে র্যাবের এ তিন কর্মকর্তাসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
কালাম সিকদার : নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর মেধাবী ছাত্র ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়েও স্থানীয় র্যাব কম জল ঘোলা করেনি। বৈধ আইনি পন্থাকে পাশ কাটিয়ে ত্বকী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে একের পর এক বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়। এদেরই একজন কালাম সিকদার। তিনি ত্বকী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন। শহরে ঘুরতে বের হলে র্যাবের টহল টিম কালাম সিকদারকে আটক করে।এরপর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়। বেশ কয়েক দিন নির্যাতনের পর ত্বকী হত্যায় জড়িত মর্মে বলে তাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে বলে র্যাব। কিন্তু শত নির্যাতনেও মিথ্যা জবানবন্দি দিতে রাজি হয়নি কালাম সিকদার। জবানবন্দি দিতে রাজি না হওয়ায় কালাম সিকদারকে আর দিনের আলোয় দেখা যায়নি। দীর্ঘদিন থেকে নিখোঁজ এই ব্যক্তি কখনও ফিরে আসবেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তার পরিবার।
তাজুল ইসলাম : সোনারগাঁয়ের বাসিন্দা ক্লিনিক ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম এলাকায় নিপাট ভদ্রলোক বলে পরিচিত ছিলেন। কথাবার্তায় সদালাপী এ মানুষটি হঠাৎ হারিয়ে যেতে পারেন- এমন কথা ভাবেনি কেউই। কিন্তু ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চরম বিভীষিকায় পড়ে তাজুলের পরিবার। এদিন হঠাৎ করে খবর আসে তাজুলকে ধরে নিয়ে গেছে র্যাব। খবর পেয়ে স্থানীয় র্যাব ক্যাম্পে ছুটে যান তাজুলের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু র্যাব তাদের সাফ জানিয়ে দেয়, তাজুল নামে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি।দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার একপর্যায়ে তাজুলের পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, তাজুলের মালিকানাধীন ক্লিনিকটি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী জনৈক ডা. কামরুজ্জামান। তিনি তাজুলকে অপহরণের নীলনকশা চূড়ান্ত করেন। যেই কথা সেই কাজ। তাজুলকে অবৈধ গুমের নাট্যমঞ্চে নেমে পড়ে র্যাব। ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাজুলের পরিবার সোনারগাঁও থানায় মামলা করেন। মামলায় ডা. কামরুজ্জামানকে প্রধান আসামি করা হয়। এই মামলার তদন্তও বেশি দূর এগোয়নি। এখন মামলাটি রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) নারায়ণগঞ্জ ইউনিটের কাছে।
ডা. ফয়েজ আহমেদ : ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১১’র হাতে নির্মমভাবে খুন হন লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. ফয়েজ আহমেদ। তারেক সাঈদের নেতৃত্বে পোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা ডা. ফয়েজ আহমেদকে গ্রেফতারের জন্য তার বাড়িতে অভিযান চালায়। তাকে বাড়ির শয়নকক্ষ থেকে আটক করে র্যাব। কিন্তু কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করে ডা. ফয়েজ আহমেদকে তারই বাড়ির ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তারেক সাঈদের নির্দেশে তার ওপর (ডা. ফয়েজ) কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়। এরপর বাড়ির ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান ডা. ফয়েজ আহমেদ।এ ঘটনায় এলাকায় আতংক নেমে আসে। স্থানীয় জনতা র্যাবের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। কিন্তু ক্ষান্ত হননি তারেক সাঈদ। তিনি ফয়েজ আহমেদের ছেলে বেলালকেও ধরে আনার নির্দেশ দেন। এমনকি তাকেও দেখামাত্র গুলি করার হুমকি দেন।
সাইফুল ইসলাম হিরু ও কবির পারভেজ : লাকসাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে র্যাবের হাতে অপহরণের শিকার হন বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর লাকসাম থেকে তিনি কুমিল্লা যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ও পৌর বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন। পথে র্যাবের লোকজন তাদের তিনজনকে তুলে নেয়। কিন্তু সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজকে আটকে রেখে জসিম উদ্দিনকে ছেড়ে দেয় র্যাব।রাজনৈতিক গ্রেফতার ভেবে হিরু ও পারভেজের পরিবার আদালতের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও তাদের খোঁজ মেলেনি। ২০১৪ সালের ১৮ মে আদালতের শরণাপন্ন হয় পরিবারের সদস্যরা। তারা র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামি করা হয় সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ, কোম্পানি কমান্ডার মেজর শাহেদ, ডিএডি শাজহান আলী, এসআই কাজী সুলতান আহমেদ ও এসআই অসিত কুমার রায়কে। এজাহারে সাক্ষী করা হয় এক র্যাব সদস্যকে। কারণ জসিম উদ্দিনকে ওই র্যাব সদস্য থানায় সোপর্দ করেন।স্পর্শকাতর এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় লাকসাম থানা পুলিশ। কিন্তু যথারীতি র্যাবের সংশ্লিষ্টতা নেই মর্মে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়। এই প্রতিবেদন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার রানু। তিনিও আদালতে নারাজি পিটিশন দেন।
ডাকাত নাটক : ২০১৪ সালের ৩ ও ৫ এপ্রিল নোয়াখালীর দুর্গম উরিরচরবাসীর জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ এই দু’দিন র্যাব-১১ ডাকাত নির্মূলের নামে উরির চরে কমান্ডো অভিযান চালায়। মুহুর্মূহু গুলিতে প্রকম্পিত হয় নির্জন চরাঞ্চল। অভিযান শেষে শাহদাত হোসেন জাসু, জাবেদ ও সুমন নামের তিন যুবকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। র্যাব দাবি করে এরা সবাই ডাকাত। র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছে বলে র্যাবের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জমা দেয়া র্যাব-১১’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ক্রসফায়ারে তিন ডাকাত নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের গল্প শোনায় র্যাব। কিন্তু সিজার লিস্টে এসব গোলাবারুদ, ট্রলার বা অস্ত্রের সন্ধান মেলেনি।’
এখানেই শেষ নয়, র্যাব সদর দফতরের নিজস্ব গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ওঠে আসে তারেক সাঈদের চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায়ের ভয়ংকর চিত্র। কিন্তু ক্ষমতাধর হওয়ায় তার ওপর র্যাব সদর দফতরের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
তারেক সাঈদ র্যাব-১১’র ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে বসে স্বেচ্ছারিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঘটে যায় আলোচিত সাত খুন। এ খুনের ঘটনাও তারা ধাপাচাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু লাশ ভেসে ওঠায় তাদের শেষ রক্ষা হয়নি।
চূড়ান্ত আপিল শুনানিতে আর কত অপেক্ষা
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট
হাইকোর্টের রায়ে যা আছে২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া নিম্ন আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নয়জনের দণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
নারায়ণগঞ্জে র্যাবের হাতে নিহত হন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন
বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।
উচ্চ আদালত বলেন, ‘আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে’