‘পেটের দায়ে এই রাস্তায় নামছি, শখে না’

IPL ের সকল খেলা  লাইভ দেখু'ন এই লিংকে  rtnbd.net/live

সারা দিনের কর্মব্যস্ততা থেকে কয়েকটি ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়ার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ বেছে নেয় রাতকে। তবে এই রাতকেই কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন পেটের ক্ষুধা নিবারনের মাধ্যম হিসেবে। যারা জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে নিজেদের পণ্য হিসেবে বিক্রি করে অন্যের তরে। নেই কোনো অভিযোগ আছে শুধু ক্ষুধা আর ক্ষুধা।
রাত এলেই রাজধানীর আনাচে কানাচে যাদের চোখে পড়বে সভ্য সমাজ তাদের নাম দিয়েছে পতিতা, যৌন কর্মীতো বটেই অনেকে আবার ‘রাতের পাখি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তবে রাত জাগা এই যৌন কর্মীদের অনেকেই ফিরতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। বাঁচতে চায় আর দশটা মানুষের মতো। সামাজিক অবজ্ঞা আর অবহেলা সইতে সইতে বিতৃষ্ণা উঠে গেছে তাদের জীবনের উপর।

যে সব যৌনকর্মী পেটের তাগিদে এ পথে এসেছে তাদের জীবনের রয়েছে একটি একটি অশ্রু সিক্ত কাহিনী। অনেকের স্বামী নেই, কারো আবার থেকেও নেই। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে এ পথে, কেউবা আবার গ্রামে অসুস্থ্য বাবার খরচ যোগাতে। প্রত্যেক যৌন কর্মীদের জীবনের চিত্র প্রায় একই রকম।

রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইল, কমলাপুর, মগবাজার, সংসদ ভবন এলাকা, ফার্মগেটসহ অভিযাত এলাকাগুলোতেও মিলবে তাদের দেখা। তবে এলাকা, বয়স, সময়, সংখ্যার হিসেবে চলবে দর কশাকশি।
কাকরাইল মোড়ে চলছে এমনই এক জুটির দামদর। যাবি? হুম। কত? কতক্ষণ? সারারাত। কয়জন? ২ জন। দুই হাজার। এতো কেন? কত দিবি? এক হাজার। না জামু না। তাইলে কত? পনেরোশ নিমু। আচ্ছা চল।
তবে এসব যৌনকর্মী সভ্য সমাজ থেকে নিজের মুখ লুকানোর জন্য পরিধান করে বোরখা। সেজেগুজে ক্রেতা ধরার অপেক্ষায় থাকে এরা। রাতে কথা হলো এমনই কয়েক জন যৌন কর্মীর সঙ্গে। যারা সারা রাতই থাকে রাস্তায় অথবা পুরুষের বাহুডোরে।

রাত গভীর হতে শরু করেছে ঠিক তখনই গলির ভেতর থেকে মুখ গুঁজে বেরিয়েছেন কয়েকজন। কেউ যুবতী, কেউ মাঝবয়েসী। কাজের সন্ধানেও বেরুয়নি তারা। রাতভর নিজেকে বিক্রি করেন এরা।

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ওদের সঙ্গে দেখা। কাছে যেতেই গলার আওয়াজ নামিয়ে এনেছে একদম নীচে। যেন নিজেদের কোনো কিছুই প্রকাশ করতে আগ্রহী নন।

পিছু নিতেই জোরসে ধমকে উঠলো একজন, ‘ওই কী চাস, দূরে যা।’ ধমক মনে হলেও এরমধ্যে ছিলো একরাশ ক্ষোভ। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারার তীব্র প্রতিবাদও ছিল এটি। খানিকটা পথ হেঁটেই উল্টো দৌড় দিলো সবাই। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল পুলিশের টহল গাড়ি। পুলিশকে যেন যমের মতো ভয় পায় ওরা সবাই।

প্রায় ১০ মিনিট পরে গলি ছেড়ে আবার বেরুলো সবাই। পুলিশকে না দেখে রাস্তার একপাশেই বসলো দু’জন। খানিকটা ক্লান্ত। একটু যেন গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। পাশে গিয়ে বসতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘পুলিশডি কোনো দিগে গেল?’ চলে গেছে জেনে এবার যেনো নিশ্চিন্ত হলো। ক্যান, পুলিশে কী সমস্যা? পাল্টা প্রশ্ন করতেই সব ঝাড়লো একসঙ্গে। একজন বলে উঠলো, ‘আরে জানেন না। মাইরা কিচ্ছু রাখে না। লাঠি দিয়া পিডাইয়া সব ফাডাইয়া দেয়।’ বলেই পায়ের কাপড় সরিয়ে দেখালো অন্যজন। আঁতকে ওঠার মতো দৃশ্য। বাম পায়ের হাঁটুর নীচে লাল হয়ে ফুলে গেছে একটি অংশ। মোটা হয়ে বসে গেছে লাঠির আঘাত।

তারপর এক এক করে ঝাড়তে লাগলো প্রতিরাতের জমে থাকা ক্ষোভগুলো। ‘পুলিশের লাইগা কিচ্ছু করন যায় না। পুলিশ আইয়া শান্তি দেয় না। খালি ট্যাকা দিলেই সব ঠিক।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।

নাম জানতে চাইলে এবার আর কোনো আড়ষ্টতা নয়। ঝটপট বললেন, ‘লাকি’। বাড়ি কই, প্রশ্ন করতেই সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘নরসিংদীর ঘোড়াশালে’। তারপর নিজ থেকেই বললেন লাকি, ‘পেটের দায়ে ইজ্জত বেচি। রাস্তায় নামছি। শখে না। কোনো কিছুর বাছ বিছার করি না। মানুষ খারাপ কয়। শরম লাগে। তবুও এইসব করি। খালি কয়ডা খাওনের লাইগা, পোলাপাইনডিরে মানুষ করনের লাইগা। তারপরেও এতো কষ্ট আর সহ্য হয় না।’

সঙ্গে থাকা মাকসুদা তখনই কথা বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ হেগো বিচার করবো। আমরা তো কারো ক্ষতি করি না। ক্ষতি যা, তা তো নিজেরই করছি। নিজেরে শেষ কইরা দিছি। আর কিচ্ছু বাকি রাখি নাই। তবুও আমাগোরে শান্তি দেয় না।’

লাকী আর মাকসুদার জীবনগল্প মোটেও সুখকর নয়। নামে লাকি হলেও জীবনগড়া তার দুঃখ দিয়েই। নরসিংদীর এ মেয়ে বড় হয়েছেন ভুলতা গাউছিয়ায়। আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে পড়াশোনার ঝাপি খুব একটা খুলতে পারেননি। বইখাতা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে ক্লাস ফাইভে ওঠার আগেই। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে বয়স হওয়ার আগে। বাবার অভাবের সংসারে নিয়ম মতো খাবার না জুটলেও ভেবেছিলেন স্বামীর সংসারে হয়তো সেটা আর থাকবে না। কিন্তু কষ্ট পিছু ছাড়েনি। মাত্র আটমাস টিকেছে সে সংসার। তারপর রিকশাচালক স্বামী আরো একজন বউ তুলে এনেছেন ঘরে। ততোদিনে লাকির পেটে নতুন মুখের কোলাহল।

শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা। নিত্য মারধর, গালাগাল। সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন লাকি। প্রতিবাদে নেমে এসেছেন রাস্তায়, বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। গত সাতবছর ধরে এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেকে। তার সন্তান লিমনের বয়সও এখন সাত বছর।

মাকসুদার গল্পেও ভিন্নতা নেই খুব একটা। বয়সে লাকির চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড়। তার সন্তান দুজন। বড় মেয়ের ক্লাস ফোরে পড়ে আর ছোট ছেলে এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। স্বামীর খবর জানতে চাইলে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মাকসুদা।

তারপর গড়গড় করে বলেন, ‘পৃথিবীতে আমার দুই সন্তান ছাড়া আর কেউ নাই। স্বামী আছে তার অন্য সংসার লইয়া। আমার লগে গত ১০ বছর ধইরা কোনো যোগাযোগ নাই।’

এমন গল্প শুনে প্রশ্ন করতে মুখ কাঁপে। তবুও জানতে ইচ্ছে করে অনেক কিছু। হয়তো বুঝতে পেরে নিজ থেকেই মাকসুদা বললেন, ‘আমাগোরে মানুষ খারাপ কয়। আমরা খারাপ কাম করি। কিন্তু কেউ তো ভালো করবো কইয়া একটা কাম দেয় না। উল্টা পারে না ঝাঁটা দিয়া পিটাইয়া বিদায় করে। হেইল্লাইগা আমরা এহানে আইয়া এইসব করি। বাড়িতে যাওনের আগে বোরখা পইরা একদম ঠিকঠাক হইয়া যাই। কেউ কোনো দিন টেরও পায় না আমরা কী করি। সবাই জানে হসপিটালে আয়ার কাম করি।’

সংসদ ভবন এলাকায় কথা হয় আরেক যৌন কর্মীর সাথে। তার গল্পটাও কিছুটা একই। তিনি আবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তিনি বলেন, ‘বাসা বাড়িতে কাজ করতাম। বাসায় যখন তার বৌ না থাকতো প্রায় প্রতি রাতেই সে আমার সাথে খারাপ কাজ করতো। মানা করলে কাজ থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দিত। পরে বাচ্চা পেটে আসে। তিন মাসের পেটে বাচ্চা নিয়ে বাসা থেকে বের করে দিল। কার কাছে বিচার দিব? চলে আসলাম রাস্তায়। এই জীবনটার কোনো দাম নাইরে ভাই। একটা কুত্তার জীবনের থেকেও খারাপ। দুই একসময় মনে হইলে ইচ্ছা করে গাড়ির তোলে মাথা দিয়া মইরা যাই।’

তবে পাশের একজন অভিযোগ করে বলেন, ‘রাস্তার একজন কুকুর মরলেও আপনার স্বাক্ষাৎকার নেন। পেপার, টিভিতে দেখান আমাদের নেন না কেন? এই জীবন আর ভাল লাগে না। আমরা কেউই ইচ্ছা করে এই নরকের জীবনে আসিনি। সরকার আমাদের যদি একটা কাজ দিত তবে এতিম বাচ্চা মারে নিয়া মান-সম্মান নিয়ে সমাজে বাঁচতে পারতাম। এই জগতে আসতাম না। পুলিশ আমাদের যে ভাবে মারে একজন চোররেও এভাবে মারে না। আমি এ পর্যন্ত দশটা বাচ্চা নষ্ট করছি একটা আমার মার কাছে আর একটা আমার কাছে।’ কথা গুলো বলছিলেন কান্নার কন্ঠে। সঙ্গে ছিল সমাজের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ।

Check Also

‘পর্যবেক্ষক নিয়োগের চেয়ে বড় প্রশ্ন কেন পর্যবেক্ষক সরানো হয়েছিল’

ইসলামী ব্যাংক থেকে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ ছিল এবং এস আলম গ্রুপকে ‘রক্ষা করার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *