প্রধান প্রকৌশলীর অপকর্মে ভেঙে পড়ছে গণপূর্তের চেইন অব কমান্ড!

IPL ের সকল খেলা  লাইভ দেখু'ন এই লিংকে  rtnbd.net/live

সরকারি অবকাঠামো উন্নয়নে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরগুলোর মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তর অন্যতম। কিন্তু গত প্রায় ২ বছরের মতো সময় ধরে দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার। তার নতজানু নীতি, জামায়াত-বিএনপি প্রীতি ও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভেঙে পড়েছে হণপূর্ত অধিদপ্তরের চেইন অব কমান্ড।

বর্তমানে কোন প্রকৌশলীই শামীম আখতারের আদেশ নির্দেশ পালন করছেন না বলে জানা গেছে। এতে করে গণপূর্ত অধিদপ্তরে এক লেজেগোবরে অবস্থার বিরাজ করছে। দায়িত্ব পালনের ২ বছরে তিনি সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর পাশ করা প্রকল্পগুলোর কাজ ছাড়া নিজ প্রস্তাবনায় নতুন কোন প্রকল্প পাশ করাতে পারেননি। এমন কি সরকারকে দিতে পারেননি নতুন কোন পরিকল্পনা।

একাধিক সুত্রে জানাগেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজের সংস্কার কাজ এবং সাতক্ষীরা ১০০ শয্যা বিশিষ্ট মেডিকেল হাসপাতালের কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দিয়ে না করিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেই সে কাজ করার জন্য লিখিত আবেদন করার পর থেকেই বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারকে সরিয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীদের মধ্য থেকে একজন প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগদানের জোর দাবি ওঠে।

সুত্রমতে, বতর্মান প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে স্বজন প্রীতির মাধ্যমে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাজ কমিশনের মাধ্যমে পাইয়ে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদ শামীম আখতারের আরেকটি পরিচয়ও রয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার ‘পীর সাহেব’। পীর হিসেবে তার নাম আল্লামা হযরত মোহাম্মদ শামীম আখতার (মাদ্দাজিল্লুহুল আলিয়াহ)। কম্বোডিয়াসহ বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানেও রয়েছে এ খানকার শাখা। পীরের মুরিদরা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। বাস্তবায়ন করছেন মোটা অংকের উন্নয়নকাজ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছেন। এ সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে।

গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর পদে আসার আগে মোহাম্মদ শামীম আখতার ছিলেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালকের দায়িত্বে। সেখানে কখনো কখনো প্রকল্প পাস না করে, কখনো টেন্ডার হওয়ার আগে কোটি কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়ে যান মুরিদ ঠিকাদাররা। মাসে লাখ টাকা বেতনে প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোয় পান নিয়োগ। মুরিদদের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন মহাপরিচালকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এইচবিআরআই থেকে একটি তদন্ত কমিটি। মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে এইচবিআরআইয়ের এ তদন্ত প্রতিবেদন।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এইচবিআরআইতে যেসব মুরিদ নিয়মবহির্ভূতভাবে সুবিধা পেয়েছেন, তারা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরে সক্রিয়। মোহাম্মদ শামীম আখতার গণপূর্তের শীর্ষ পদে যোগ দেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর গণপূর্ত প্রশিক্ষণ একাডেমি, একটি পূর্ত ভবনের উন্নয়ন, প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন সংস্কারসহ একাধিক প্রকল্পের কাজ পেতে শুরু করেন মুরিদরা। এরই মধ্যে তারা জায়গা করে নিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তর ঠিকাদার সমিতিতে। সর্বশেষ গত ১৬ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে ঠিকাদারদের মতবিনিময় সভায়ও উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন মুরিদ।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূঁইগড় বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্বদিকে কয়েকশ গজ দূরে হাকিমাবাদ খানকা শরিফের অবস্থান। খানকা শরিফের এক পাশে একটি বহুতল নূরানী মাদ্রাসা ও আরেকটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা। অন্যপাশে মসজিদ। মাঝখানে বিশাল প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণ লাগোয়া একটি পুকুরও রয়েছে। জুমার নামাজ ও জুমা-পরবর্তী পীর সাহেবের বয়ানের জন্য খানকা প্রাঙ্গণে বানানো হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। জুমার নামাজের পর পরই মসজিদের বারান্দা থেকে ভক্ত-আশেকান আর মুরিদদের উদ্দেশে বয়ানে বসেন পীর সাহেব মোহাম্মদ শামীম আখতার। কয়েকটি বিশাল পাতিলে আগত ভক্ত-আশেকান, মুরিদের জন্য ছিল ভোজনের ব্যবস্থাও। ৩ ডিসেম্বর খানকা শরিফে এইচবিআরআইয়ের তৈরি কয়েক হাজার ব্লক ইটও দেখা গেছে, যেগুলো খানকার উন্নয়নকাজে ব্যবহারের কথা রয়েছে।

এইচবিআরআই ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, খানকার মুরিদদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন ‘পীর সাহেব’। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে অধিদপ্তরের কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ। ঠিকাদারির পাশাপাশি নিয়ম ভেঙে মুরিদদের নানা সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ‘নন ফায়ার ব্রিক প্লান্ট’ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্সের সঙ্গে চুক্তি করে এইচবিআরআই। আইন অনুযায়ী, ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এমনকি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে এইচবিআরআইয়ের বাজেটও নেই। তার পরও ‘নন ফায়ার ব্রিক প্লান্ট’ নির্মাণের প্রায় ১৪ কোটি টাকার কাজ কিংডম বিল্ডার্সকে দেন সংস্থাটির তৎকালীন মহাপরিচালক, যার কাজ এখনো শুরু হয়নি। কিংডম বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুসরত হোসেনকে পীর সাহেবের ঘনিষ্ঠ মুরিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। কিংডম বিল্ডার্স, কিংডম হাউজিং, কিংডম কনস্ট্রাকশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নুসরত হোসেন।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে এইচবিআরআইয়ের গবেষণা খাতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। গবেষণা খাতের এ টাকা থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকায় ‘অটোমেটিক ব্লক মেকিং প্লান্ট’ স্থাপন করা হয়। এ কাজও পায় কিংডম বিল্ডার্স। ঠিকাদারকে সব বিল প্রদান করা হলেও প্লান্টটির কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থার অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠনের নিয়ম থাকলেও সে ধরনের কোনো কমিটিই হয়নি। অন্যদিকে একই প্লান্টের শেড নির্মাণের জন্য ৭০ লাখ টাকার কাজে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই কিংডম বিল্ডার্সকে নিযুক্ত করা হয়। অর্ধকোটি টাকায় একই কাজ আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অর্থি এন্টার প্রাইজকে দেয়া হয়, যার মালিক আল আমীনকেও পীর সাহেবের মুরিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে।
দৈনিক ২০ ঘনমিটার ব্লক উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্যে ‘এসিসি প্লান্ট’ উন্নয়নকাজে ২০১৯ সালে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। কাজটি করে কিংডম বিল্ডার্স, অর্থি এন্টার প্রাইজ ও জামান বিল্ডার্স। ঠিকাদারদের সিংহভাগ বিল দেয়া হলেও এখনো চালু হয়নি প্লান্টটি, উল্টো কাজ শেষ করতে আরো সাড়ে ৩ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে তারা।
একই সময়ে প্রায় ১ কোটি টাকায় এইচবিআরআইয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় কিংডম বিল্ডার্স। চুক্তির চেয়ে ঠিকাদারদের ৮ লাখ টাকা বেশি বিল দেয়া হলেও কাজটি থেকে গেছে অসমাপ্ত। অন্যদিকে দরপত্রের আগেই অফিস সংস্কারের কাজ শুরু করে দেয় অর্থি এন্টার প্রাইজ।
এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক থাকাকালে পীর সাহেবের আরেক ঘনিষ্ঠ মুরিদ ছিলেন মোহাম্মদ ইয়ামীন। ক্যামিকন গ্রুপ নামের একটি কেমিক্যাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা বেতনে ইয়ামীনকে স্যান্ড সিমেন্ট ব্লক তৈরির কাজে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন এইচবিআরআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামীম আখতার। কোনো টেন্ডার ছাড়াই আড়াই কোটি টাকার কাজ দেন ইয়ামীনকে। নিযুক্ত করেন গবেষণার কাজে। এইচবিআরআইয়ের টাকায় গবেষণা করে উৎপাদন করা কেমিক্যাল এইচবিআরআইয়ের কাছেই বিক্রি করেছেন ইয়ামীন।
নিয়মবহির্ভূতভাবে ঠিকাদারি কাজ পাওয়া ছাড়াও রিসার্চ আর্কিটেক্ট, সিনিয়র ড্রাফটসম্যান, সহকারী মেকানিক, পেইন্টার, বাবুর্চি, মালিসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন মুরিদরা। মোহাম্মদ শামীম আখতারের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে এইচবিআরআই ও দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক চিঠিও দিয়েছেন এইচবিআরআইয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এইচবিআরআই মূলত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বার্ষিক বাজেট ১০-১২ কোটি টাকার আশপাশে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশের অবকাঠামো খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরে পীর সাহেবের যোগদানের পর পরই সেখানে সক্রিয় হয় কিংডম বিল্ডার্স।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বর্তমানে গণপূর্ত অধিপ্তরের ট্রেনিং একাডেমি উন্নয়ন, পূর্ত ভবন ও প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন সংস্কারের কাজ করছে নুসরত হোসেনের প্রতিষ্ঠানটি। গত ১৬ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে ঠিকাদারদের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানেও উপস্থিত ছিলেন নুসরত হোসেনসহ কয়েকজন ঠিকাদার, যারা পীর সাহেবের ঘনিষ্ঠ মুরিদ হিসেবে পরিচিত। মোহাম্মদ শামীম আখতার এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক থাকাকালে সেখানে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে, তার প্রায় সবই এখন সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরে।

সারাদেশের গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে এখন শ্লোগান ওঠেছে, ‘শামীম আখতার হটাও গণপূর্ত বাঁচাও’। এ বিষয়ে গণপূর্তের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মন্তব্য হলো: গণপূর্ত বিভাগ সৃষ্টির পর থেকে এমন অযোগ্য ও অদক্ষ প্রধান প্রকৌশলী তারা একটিও পাননি। তাকে যত তাড়াতাড়ি প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে অপসারণ করা হবে ততোই অধিদপ্তরের মংগল হবে। এ বিষয়ে তারা প্রধান মন্ত্রীর দ্রুত পদক্ষেপ কামনা বরেছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘অনেকগুলো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে। একটা একটা করে এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর অভিযোগগুলো যেহেতু মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে, সেহেতু এ অবস্থায় আমার এসব বিষয়ে মন্তব্য করাও ঠিক হবে না। মন্ত্রণালয় ও এইচবিআরআইয়ের কর্মকর্তারাই বিষয়গুলো নিয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

Check Also

জিল্লুর রহমানের বাড়িতে পুলিশের হানা, যা বললেন জিল্লুর রহমান

জনপ্রিয় টক শো ‘তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক ও পরিচালক জিল্লুর রহমান এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, পুলিশ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *